স্বজন চক্রবর্তী " তবু সেই স্বাধীনতা আমার"



১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ... 'অপারেশন সার্চলাইট'-এর নাম দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর চালায় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা। সিডনির 'মর্নিং হোরাল্ড' লিখেছিল শুধুমাত্র এই কালো রাত্রিতেই নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমেরিকার 'সেন্ট লুইস পোস্টে' যুক্তরাষ্ট্রের এক শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছিল;- "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর চালানো গণহত্যার এই হত্যাকাণ্ড হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।" বৃটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বলেছেন ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যার যে চিত্র তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চলাকালীন সময়ে পরবর্তী নয় মাস তা অব্যাহত ছিল। উনার মতে এই নয় মাসে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। ১৯৭১ সালের ২০ মে... এই দিন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেরলার চুকনগরে সংগঠিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস একটি গণহত্যা। ভারতের সীমান্তবর্তী একটি খুলনা জেলার অন্তর্গত একটি গ্রামের নাম 'চুকনগর'। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা 'ভদ্রা' নদী। সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে আশেপাশের এলাকার সব মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল চুকনগরে। হয়তো তাঁদের বিশ্বাস ছিল;-"পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসার খবর পেলেই সহজেই ভারত চলে যেতে পারব। যতদিন সম্ভব মাতৃভূমির মাটিতে থাকি।" ২০মে পাকিস্তানি সৈন্যদের দুইটি ট্রাক ও একটি জিপ এসে থামে চুকনগরে। তারপর শুরু হয় বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় চুকনগরে এসে জড়ো হওয়া নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষদের উপর তৎকালীন সময়ের আধুনিকতম এবং স্বয়ংক্রিয় সব অস্ত্র দিয়ে টানা গুলিবর্ষণ। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ঘটনার যেসব প্রত্যক্ষদর্শী সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের সবারই ভাষ্য নিয়ে জানা গেছে অন্তত ২০ হাজার মানুষ সেদিন নিহত হয়েছিলেন। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা এই ৫ ঘন্টাতেই পাকিস্তানিরা খুন করেছিল ২০ হাজার মানুষকে। ধারনা করা যায় লাশের সারিটা কত দীর্ঘ ছিল? -২০ হাজার মানুষে লাশ। লাশগুলো পাকিস্তানিরা 'ভদ্রা' নদীতে ফেলে দিয়েছিল। মানুষের রক্তে সেদিন নাকি ভদ্রা নদীর পানি নাকি লাল হয়ে গিয়েছিল। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানিরা চালিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টানা ৯ মাস ধরে। সর্বশেষ আঘাতটি তারা করেছিল ১৪-ই ডিসেম্বর। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে নিজেদের সবচেয়ে জঘন্য ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়ন করে। যেন স্বাধীনতার পর দেশটিকে গড়ে তোলার মতো যোগ্য মানুষেরা আর না থাকেন। প্রথমে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া ইত্যাদি এলাকার 'টর্চার শেলে' নিয়ে যাওয়া হয়। নৃশংস নির্যাতন চালানোর পর 'রায়েরবাজার বধ্যভূমি' এবং 'মিরপুর বধ্যভূমিতে' নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়। ১৬-ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণের পর নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা লাশ সন্তাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। পঁচে যাওয়া, গলে যাওয়া, আর নির্যাতনের ফলে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশ থেকে অনেকেই সনাক্তই করতে পারেন নি তাঁদের আপনজনকে। যাঁরা লাশ সনাক্ত করতে পেরেছিলেন লাশের চেহারা দেখে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। অধিকাংশ লাশেরই চোখ ছিল উপড়ানো, শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই দেশ এমন সব ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশ। এমন দেশে জন্মেও, এই ইতিহাস জানার পরেও যারা রাজাকার-আলবদরদের জন্য মানবতা দেখাতে যায়, খেলায় পাকিস্তান সমর্থনেও উদারনীতি দেখতে পায় সেইসব জ্ঞানীর ভাব নেওয়া ঘোড়ামূর্খদের জন্য করুণা থাকল। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি স্বাধীনতার তরে জীবন উৎসর্গ করা সকল মানুষদেরকে। হয়তো রাষ্ট্রটি ব্যর্থ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে। হোক ব্যর্থ তবুও সেই স্বাধীনতা আমার।
লেখক: স্বজন চক্রবর্তী  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Share on Google Plus

About Anonymous

0 comments:

Post a Comment